তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশটির ক্ষমতায় আছেন। এবারের নির্বাচনে তিনি বিরোধীদের সবচেয়ে কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দেশটির ছয়টি বিরোধীদল আগামী ১৪ মে অনুষ্ঠিতব্য প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জোট গড়েছে। এই জোটের নেতারা প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে একক প্রার্থী হিসেবে বিরোধী নেতা কেমাল কিলিচদারুগলুকে সমর্থন দিয়েছে।
এরদোয়ানের দুই দশকের শাসনামলে তুরস্ক ক্রমান্বয়ে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এখন এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চান। লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি আর সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে তুরস্কে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পর এরদোয়ানের অবস্থা এখন অনেকটাই নাজুক।
আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যতো ভোট পড়বে, কোনও প্রার্থী যদি তার ৫০ শতাংশের বেশি পান, তাহলে তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। এ রকম না হলে নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পর সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফায় ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হবে।
তুরস্কের ভোটাররা গত কয়েক বছর ধরে বিভক্ত। কিন্তু ৬৯ বছর বয়সী এরদোয়ান এবার যতোটা চাপের মুখে পড়েছেন, এর আগে এরকম কখনও হয়নি।
বিভিন্ন জনমত জরিপে প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী জোটের প্রার্থীকে এরদোয়ানের চেয়ে এগিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি) ২০০২ সালের নভেম্বর মাস থেকে ক্ষমতায় আছে। এরদোয়ান তুরস্ক শাসন করছেন ২০০৩ সাল থেকে।
এবারের নির্বাচনে প্রায় ৬০ লাখ নতুন ভোটার ভোট দেবেন যারা এরদোয়ান ছাড়া আর কোনও রাজনৈতিক নেতাকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে দেখেননি। এরদোয়ান শুরুতে ছিলেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী। ২০১৪ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হন এবং ২০১৬ সালে ব্যর্থ এক সামরিক অভ্যুত্থানের পর নাটকীয়ভাবে তিনি তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। হয়ে ওঠেন দেশের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী।
এখন তিনি বিশাল একটি প্রাসাদ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। দেশটির বেশিরভাগ মিডিয়াই তার মিত্রদের নিয়ন্ত্রণে। প্রচুর সংখ্যক তুর্কী নাগরিক দেশটিতে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির জন্য এরদোয়ানকে দায়ী করেন। কারণ তিনি ব্যাংকের সুদের হার বাড়াতে রাজি হননি।
বর্তমানে তুরস্কে সরকারিভাবে মূল্যস্ফীতির হার ৫০ শতাংশের বেশি। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই হার আসলে ১০০ শতাংশেরও বেশি।
তুরস্কে ৬ ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ জোড়া ভূমিকম্পের পর এরদোয়ান ও তার নেতৃত্বাধীন শাসক দলের ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। তার সরকারের বিরুদ্ধে উদ্ধার তৎপরতা ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ উঠেছে, নির্মাণখাতে বড় ধরনের অনিয়মের কারণেই ভূমিকম্পে এতো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভূমিকম্পে তুরস্কের ১১টি প্রদেশের লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছেন।
এরদোয়ানের প্রতি প্রচুর সমর্থন থাকার কারণে এসব প্রদেশের কয়েকটিকে তার পার্টির ঘাঁটি হিসেবে দেখা হতো। ধারণা করা হচ্ছে এসব প্রদেশের ওপরেই এরদোয়ানের জয় পরাজয় নির্ভর করছে।
তার রাজনৈতিক দল এ কে পার্টি ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করেছে। কিন্তু তিনি তুরস্কের উগ্র-জাতীয়তাবাদী দল এমএইচপির সাথে জোট গঠন করেছেন।
৭৪ বছর বয়সী কেমাল কিলিচদারুগলু একজন সজ্জন ও পণ্ডিত ব্যক্তি। প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি বা সিএইচপির প্রধান তিনি। এর আগে বিভিন্ন নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন সিএইচপি পরাজিত হয়েছে।
তবে এবারের চিত্রটা ভিন্ন রকমের হতে পারে। কারণ এরদোয়ানের বিরুদ্ধে তিনি লড়ছেন বিরোধী জোটের একক প্রার্থী হিসেবে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে ঠেকাতে ছয়টি বিরোধী রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে এই জোট গঠন করেছে।
এই জোটে রয়েছে কিলিচদারুগলুর নিজের মধ্য-বামপন্থী দল সিএইচপি, জাতীয়তাবাদী গুড পার্টিসহ আরও চারটি ছোট ছোট দল। যাদের মধ্যে এরদোয়ানের সাবেক দু’জন মিত্রও রয়েছেন এবং তাদের মধ্যে একজন ক্ষমতাসীন এ কে পার্টির সহ-প্রতিষ্ঠাতা।
বিরোধীজোটের প্রার্থী কিলিচদারুগলুর প্রতি তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল কুর্দীপন্থী এইচডিপির ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। এই দলের একজন নেতা এবারের নির্বাচনকে ‘তুরস্কের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
এইচডিপির সাথে কুর্দি মিলিট্যান্টদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে; এমন অভিযোগে দলটির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা থাকার কারণে দলটি নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। কিন্তু এই দলের নেতারা অন্য একটি দল গ্রিন লেফটের ব্যানারে পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দলটি কোনও প্রার্থী দেয়নি। কেমাল কিলিচদারুগলুকে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে একক প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানোয় সবাই যে খুশি তা নয়। কারণ অনেকেই মনে করেন, আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলের মেয়র তার চেয়েও শক্তিশালী প্রার্থী হতে পারতেন।
এই দু’জন মেয়রই কিলিচদারুগলুর রাজনৈতিক দল সিএইচপির নেতা। ২০১৯ সালে তারা তুরস্কের বৃহত্তম এই দুটো শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৯৪ সালের পর ওই দুই শহরে এই প্রথম সিএইচপি দল জয়লাভ করে।
কিলিচদারুগলু একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা। তিনি তুরস্কের আলেভি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য। তিনি ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সরকারের বিরুদ্ধে ২৪ দিন ধরে চলা এক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই আন্দোলনকে দেখা হয় গত কয়েক বছরের ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আন্দোলন হিসেবে।
এবারের নির্বাচনকে সামনে রেখে তার নেতৃত্বেই গঠিত হয়েছে বিরোধী জোট ন্যাশন্স অ্যালায়েন্স; যা টেবিল অব সিক্স নামেও পরিচিত। এই জোটের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য তুরস্ককে রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে তুরস্কে রাষ্ট্রপতির শাসন চালু করেন।
এই শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে তাদেরকে ৬০০ আসনের পার্লামেন্টে ৪০০টি আসনে জয়ী হতে হবে। অথবা এ বিষয়ে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব পাস করতে তাদের ৩৬০ জন এমপির প্রয়োজন হবে।
এই জোট নির্বাচিত হলে কিলিচদারুগলু হবেন তুরস্কের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। এবং জোটের বাকি পাঁচটি শরিক দলের নেতারা ভাইস-প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে সম্মত হয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন :