উৎপাদন ব্যয়ের দ্বিগুণে বিক্রি মুরগির মাংস, কেন?


chandpurnews24 প্রকাশের সময় : মার্চ ২৫, ২০২৩, ৪:০৮ অপরাহ্ন /
উৎপাদন ব্যয়ের দ্বিগুণে বিক্রি মুরগির মাংস, কেন?

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর তাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে সম্প্রতি যথেষ্ট আলোচনায় এসেছে। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান এইচএম শফিকুজ্জামান বিভিন্ন টকশোতে খোলামেলা কথা বলেন। উচিত কথা বলতেও ছাড়েন না। তার অধিদফতর সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যাতে বলা হয়-এক কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন ব্যয় করপোরেট গ্রুপ পর্যায়ে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকার বেশি পড়ে না।

প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে এটা সর্বোচ্চ ১৫০-১৬০ টাকা হতে পারে। উৎপাদন ব্যয় ও নিয়মিত লাভ বিবেচনায় নিলে বাজারে এক কেজি ফার্মের মুরগির মাংসের দাম ২০০ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। অধিদফতর এ হিসাব করেছে দেশের বাজারে ও বিশ্ব বাজারে পোলট্রি ফিড, জ্বালানি তেল অন্যান্য পণ্যের দাম নানা কারণে যথেষ্ট পরিমাণে বেড়ে যাওয়ার পর। কিন্তু ২০ মার্চ রাজধানী ঢাকার বাজারে এক কেজি ফার্মের মুরগির মাংসের দাম ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা। দেড় থেকে দুই মাসে ফার্মের মুরগির দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে ১০০ টাকার মতো।

মাংসের বাজারে কেন এমন অনিয়ম, বাণিজ্যমন্ত্রীকে সে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, প্রাণী সম্পদ মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করুন। কেন বাজারে এ অস্থিরতা? কারা এ জন্য দায়ী? মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হলে সব মানুষ অনেক অনেক ভালো থাকবে, এমন কথা আমরা শুনেছি। আশির দশকে- অর্থাৎ এখন থেকে ৩৫-৪০ বছর আগে মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থকরা প্রচার করতে থাকে-ব্যবসায়ে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। সরকার কেবল সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

ঋণ নিয়ে ধনবানরা কী করবে, সে প্রশ্ন করা যাবে না। সে সময় সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ ক্ষমতায়। তার আগে জিয়াউর রহমান ৫-৬ বছর বাংলাদেশ শাসন করেছেন। তাদের শাসনামলে বেশিরভাগ সময় সংবাদপত্রের টুটি চেপে রাখা হতো। আর টেলিভিশন ও বেতার তো বরাবর ছিল সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে। এই দুই সেনাশাসক ব্যাংকিং খাত ছেড়ে দেন বেসরকারি খাতে। যে কোনো ব্যাংকে মূলধনের জোগান আসে আমানতকারীদের সঞ্চিত অর্থ থেকে। কিন্তু আমরা শুনতে পাই ‘ব্যাংকের মালিক’ শব্দ দুটি। অর্থাৎ ব্যাংকের উদ্যোক্তারাই মালিক। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব ব্যাংক জাতীয়করণ করেছিলেন।

সামরিক শাসকরা বেসরকারি খাতে ব্যাংক চালুর অনুমতি প্রদান করেন। একইসঙ্গে কয়েকটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকও ছেড়ে দেয়া হয় সাবেক মালিকদের হাতে। সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন শিল্প-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলোও ছেড়ে দেয়া হয় ব্যক্তি খাতে। কৃষিতে সার, সেচযন্ত্র ও কীটনাশকের ব্যবসা চলে যায় বেসরকারি খাতে। ব্যক্তি খাতের উত্থানের পেছনে বিশ্বব্যাংক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ছিল প্রবল। আমাদের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণের প্রয়োজন ছিল। কোনো কোনো বছর তো উন্নয়ন বাজেটের সবটাই আসত দাতাদের ঋণ ও অনুদানে।

প্রতি বছর বাজেট প্রণয়নের আগে বিশ্বব্যাংকের সভাপতিত্বে বাংলাদেশকে ‘সাহায্যদাতাদের’ কনসোর্টিয়াম বৈঠক বসত ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। এ বৈঠকের জন্য দাতাদের কাছে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় একটি কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করত। তাতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে তুলে দেয়া, রেশনসহ বিভিন্ন খাতে সরকারি ভর্তুকির অবসানসহ অতীতে করা বিভিন্ন  সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকার কী কী করেছে তার ফিরিস্তি থাকত। আর বৈঠক থেকে বলে দেয়া হতো- সরকার পরবর্তী বছরে পুঁজিবাদী পথ ধরে চলার জন্য কী কী করবে এবং কী কী করবে না। সে সময় আমরা শুনেছি, একটি দম্পতি কতটি সন্তান গ্রহণ করবে, সেটাও বলে দিত বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এবং তাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা যুক্তরাষ্ট্র।

তাদের পরমর্শেই বাংলাদেশে রেশন ব্যবস্থা উঠে যায়। তাদের চাপেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটকল আদমজী জুটমিল বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয় হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। তাদের চাপেই কৃষি পণ্যের ব্যবসায় করপোরেট হাউসগুলোর দাপট-দৌরাত্ম্য আমরা দেখতে পাই। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে চাল কেনে প্রতি কেজি ৪২ টাকায়। কিন্তু কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই দামে বা আরও কম দামে চাল কিনে সুদৃশ্য প্যাকেট বা বস্তায় ভরে বিক্রি করে ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে। এক সময় সরকারি গুদামে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত থাকত। এখনও সেটা আছে। কৃষকের গোলাতেও ধান-চাল মজুত থাকে। কিন্তু এখন বেসরকারি চালকল মালিক ও করপোরেট হাউসগুলোর গোডাউনেও প্রচুর চালের মজুত। আলু, ডিম, মাংস, দুধ, ফল, মাছ- এ সবেরও ওপরেও তাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে। তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। বেশি বৃষ্টি হয়েছে বা কুয়াশা পড়েছে কিংবা হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে ট্রাক চলেনি, এ ধরনের অজুহাতে প্রতি কেজি চালের দাম একদিনে ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। বিশ্ব বাজারে যখন চালের দাম কম থাকে, সেই চাল বাংলাদেশে আমদানি করে বিক্রিতেও এ মহলের প্রবল আপত্তি।

অন্য অনেক পণ্যের একই চিত্র। কেন এমনটি হবে? এটা ঠিক যে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় সরকারি লোকজন যথেষ্ট দক্ষতা দেখাতে পারেনি। আবার এটাও তো দেখি যে সরকারি চাকরি ছেড়ে ব্যক্তিগত ব্যবসায় যুক্ত হয়ে অনেকে যথেষ্ট ভালো করছে। সরকারের বদলি নীতিও এ ক্ষেত্রে দায়ী। আজ যিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ে, কিছুদিন পর তাকে দেখা গেল ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে, আরও কিছুদিন পর রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রেলওয়েতে কিংবা খাদ্য দফতরে। এত দক্ষতা কোথায় রাখেন তারা?

বাংলাদেশে এক সময় ব্যাংকের আমানত ও ঋণ ছিল সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকগুলোতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর সরকারি-বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর আমানত ছিল প্রায় ১৫ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে ঋণ দেয়া হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। ঋণের অর্থের বড় অংশ পেয়েছে অতি ধনবানরা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বলছেন, তারা প্রয়োজনের সময় ঋণ পাচ্ছেন না। কারণ অতি ধনবান কিছু ব্যক্তি বা পরিবার ব্যাংকের আমানত নিয়ন্ত্রণ করছে।

প্রাইভেট সেক্টর চলবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার নিয়ম মেনে, কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি স্থান পাবে না-এভাবেই তো বলা হতো। তাহলে কেন ব্যত্যয় ঘটছে?

কেবল ব্যাংক কিংবা শিল্প-বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠান নয়, পরিবহন খাতে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ। যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু ও পদ্মা সেতু আমাদের কতই না গর্বের। কিন্তু এ সব সেতু চালুর পর পরিবহন খাতের শেঠরা কোনো নিয়মকানুন মানতে চাইছে না। তারা নিন্মমানের বাস-ট্রাক চালাবে, চালকদের প্রতিদিন বেশি সময় কাজ চালাতে বাধ্য করবে। কিন্তু কোনো হস্তক্ষেপ চলবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও রোগনির্ণয় প্রতিষ্ঠান-সব স্থানে এখন বেসরকারি খাতের দাপট। রোগী বা শিক্ষার্থীর পকেট কাটা হলেও কেউ কিছু বলতে পারবে না।

আবার দেখা যাচ্ছে যিনি একাধিক বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, তিনিই শিল্প ও বণিক সমিতির নেতা এবং তিনিই টেলিভিশন কেন্দ্র ও সংবাদপত্রের মালিক। আবার তাকেই আমরা দেখি জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে এমনকি মন্ত্রী পদেও। এমপি-মন্ত্রী হয়েই সন্তুষ্ট থাকেন না কেউ কেউ- তাদের পরিবারের পুরুষ ও নারী সদস্যদের জন্য চাই দল ও অঙ্গ সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং পৌরসভার মেয়র বা উপজেলা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের পদেও চাই নিজের লোক।

ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে থেকে যিনি ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে নানা কৌশলে চার্জ-সুদের অঙ্ক বাড়িয়ে নিচ্ছেন, চেম্বারের নেতা পদে আসীন হয়ে তিনিই দাবি করছেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমিয়ে দিতে হবে। এ সময় তার মনে থাকে না যে ব্যাংক আমানতের ৭৫ ভাগের বেশি এখন নিয়ন্ত্রণ করেন সরকার নয়, বেসরকারি খাতের ‘মালিকরা’।